টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি
তাজলিমা খাতুন।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মধুপুর গড় এলাকা ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের তিনটি প্রধান ভূমিকম্পন বলয়ের মধ্যে মধুপুরে একটি বলয় রয়েছে যা মধুপুর ফল্ট নামে পরিচিত। এ প্লেটের কারণে টাঙ্গাইলসহ সারাদেশে উচ্চ মাত্রায় ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে টাঙ্গাইল জেলা ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
শুক্রবার ও শনিবার দেশে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পনের পর আবারো মধুপুর ফল্টের আলোচনায় নাম উঠে এসেছে। মধুপুর ফল্টে উচ্চ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে বহু হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিগত সময়গুলোতে মধুপুর ফল্টে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প সংঘটিতও হয়েছে। তবে মধুপুরের স্থানীয়দের দাবি, ভূমিকম্পের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সচেতনতা কার্যক্রম করা হয়নি।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- মধুপুর ফল্টে ৬ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকার প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা থেকে দূরত্ব কম হওয়ায় আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে মধুপুর ফল্ট। ভূস্তরে মধুপুর টেকটোনিক বলতে যা বোঝায় তা শুধু মধুপুর উপজেলাকে বোঝায় না, বরং মধুপুর গড়ের পুরো এলাকাকে বোঝায়। সুতরাং মধুপুর ফল্টের ভূমিকম্পের জন্য শুধু ঢাকা নয়, মধুপুর গড়াঞ্চলের টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং গাজীপুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আর এ ভূ চ্যুতি ঢাকার কাছে হওয়ায় এখানে ভূমিকম্প হলে ঢাকার ক্ষয়ক্ষতি হবে ভয়াবহ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মধুপুর ফল্ট একটি সক্রিয় ফল্ট, যা যেকোনো সময় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। ঢাকা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর অঞ্চলে ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো ভূতাত্ত্বিক ফাটল রেখা রয়েছে। এর ফলে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকাসহ আশপাশের অনেক জেলা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে কিছু ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল টাঙ্গাইলের মধুপুরে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টাঙ্গাইলে ৪.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল এই মধুপুর। মধুপুর উপজেলার গড় এলাকার বোকারবাইদ গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বক্রাকারে তিন থেকে চার ইঞ্চি ব্যাসার্ধের প্রায় আধা মাইল দীর্ঘ এ ভূ-ফাটল দেখা দিয়েছিল। এ ফাটলের গভীরতা ছিল ১৫ থেকে ২০ ফুট। এর আগে সর্বপ্রথম মধুপুর ফল্টে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হয়েছিল।
২০১০ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, মধুপুর ফল্টে রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ৩১৬টি পাকা ভবন ধসে যেতে পারে এবং আংশিক ক্ষতি হতে পারে ৫৬ হাজার ১৬৬টি ভবনের।
২০০৮ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে পরিচালিত আরেক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে টেকটোনিক প্লেটের সীমানায় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ২ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৪টি ভবন ধসে পড়তে পারে।
এদিকে ভূমিকম্পের আশঙ্কার মধ্যেই অপরিকল্পিতভাবে টাঙ্গাইল শহরসহ আশেপাশে বিভিন্ন এলাকায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং নির্মাণ কাজ চলছে। এতে করে ঝুঁকি বাড়ছে টাঙ্গাইল শহরে। পৌরসভার আওতাধীন এলাকায় ভবনের ভারবহনের ক্ষমতা, যাচাইসহ এর স্থাপত্য, কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক, মেকানিক্যাল, প্লাম্বিং, অগ্নিনিরাপত্তার নকশা অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ভবনের নকশার অনুমোদন নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
মধুপুরের বাসিন্দা ও জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি অজয় মৃ জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সচেতন করার ব্যাপারে কোনো কার্যক্রম করা হয়নি। মধুপুর ফল্টের ভূমিকম্প নিয়ে কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা শঙ্কিত। কারণ আমরা মধুপুর ফল্টের ওপরই বসবাস করছি। ভূমিকম্প নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সচেতন করতে হবে। বিগত সময়ে ভূমিকম্পে ফাটল দেখা দিয়েছিলো।
ভূমিকম্পের বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স অ্যান্ড সাইন্সের অধ্যাপক মীর মো. মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের তিনটি প্রধান ভূমিকম্পন বলয়ের মধ্যে মধুপুরে একটি বলয় রয়েছে যা মধুপুর ফল্ট নামে পরিচিত। মধুপুর ফল্টের ব্যাপ্তি টাঙ্গাইলসহ ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকার ১ কিলোমিটারের মধ্যে। গত দুইদিনেই ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় ৪টি ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়াও ঢাকার আশপাশেই আরও কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে ঢাকার আশপাশে কিংবা মধুপুর ফল্টে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। মধুপুর ফল্ট যেকোনো সময় সক্রিয় হতে পারে বলে আমরা শঙ্কা করছি।
তিনি আরও বলেন, মধুপুর ফল্টে ৬ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকার বিস্তীর্ণ অংশ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। ভূমিকম্প হবেই। এটি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় নেই। তবে আমাদের সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, ১৯৫০ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছিল। যার ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নতুন ব্রহ্মপুত্র তৈরি হয়েছিল। এদিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় টাঙ্গাইল অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে। ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে টাঙ্গাইল জেলা।
গত কয়েক বছর ধরে জেলায় বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। বিশেষ করে এসব বহুতল ভবন একটার সঙ্গে আরেকটা প্রায় লাগানো অবস্থায় তৈরি করা হয়েছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এসব ভবন ধসে প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মধুপুর ফল্টের কারণে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মধুপুর ফল্ট নিয়ে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানানো হবে। দুর্যোগ প্রশমন দিবসে ভূমিকম্প পরবর্তীতে করণীয় বিষয়ে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম দেখিয়েছি। তবে স্থানীয়দের সচেতনতার জন্য দ্রুতই মহড়া করা হবে।
এ প্রসঙ্গ