পশুর নদীতে পোনা ধরে জীবন চলে খুকু দাশের
প্রতিনিধির নাম :
-
প্রকাশিত:
রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫
-
৫
বার পড়া হয়েছে

মোঃ শামীম হোসেন – স্টাফ রিপোর্টার
বিকেলের শেষ আলোয় পশুর নদীর চরে পা রাখতেই নরম কাদায় দেবে গেল পা। নদীর লোনাপানি ছুঁয়ে কয়েক কদম এগোতেই চোখে পড়ল পানির মধ্যে জাল টেনে চরের কাদায় চুপচাপ দাড়িয়ে আছেন খুকু দাশ (৫০)। পাশে অগোছালো কাদায় পা গেড়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর স্বামী বিন্দু দাশ। দুজনে মিলে গুনছেন চিংড়ির রেণু পোনা। কাছে গিয়ে এই প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করেন, ‘কত পোনা পেলেন?’ খুকু বলেন, ‘আজ কপাল ভালো ভাই, ১৯টা পাইছি। তিন ঘণ্টা জাল টাইনে এইগুলা পাইছি।’ পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বামী যোগ করলেন, পানিতে জাল টানা খুব কষ্টের কাম। আগে আমি টানতাম। শরীর খারাপ, এখন আর পারি না। তাই ওকে করতে হয়।’শনিবার বিকেলে খুলনার দাকোপ উপজেলার লাউডোব ইউনিয়নের পশুর নদীর চরে দাঁড়িয়ে গল্প হচ্ছিল খুকু দাশ ও বিন্দুর সঙ্গে। কথা বলতে বলতে জানা গেল, বিন্দুর হৃৎপিণ্ডে রোগ বাসা বেঁধেছে। একসময় এই নদীই ছিল তাঁদের ভরসা। নৌকা ছিল, জাল ছিল—সুন্দরবনের নদীতে দুজনে মিলে মাছ ধরতেন, পোনা তুলতেন। এখন খুকুকে একাই পোনা ধরার কাজ করতে হয়। জালে ধরা পোনা থালায় তুলে আলাদা করতে করতে খুকু দাশের দূরের চরের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, ‘ওইখানেই ছিল আমাদের ঘর। আইলায় সব ভাসাই নিল। এখন বেড়িবাঁধের ধারে কোনোমতে পইড়ে আছি। এক ছেলে–দুই মেয়ে সবাই বিয়া করে আলাদা। ওরা নিজেরাই টানাটানিতে আছে, আমাদের দেখবে কেমনে? নিজের জায়গাজমিও নাই।’
বেড়িবাঁধের ধারে ছোট্ট ঝুপড়িটুকুই এখন তাঁদের শেষ ভরসা। বিন্দু সানা হেসে বললেন, ‘গেরস্তের গরু-ছাগলও আমাদের চাইতে ভালো থাকে। গাঙে বেশি জোয়ার হলি ঘরের কোনায় পানি উঠে যায়। নদীর পাড়ে শুধু খুকু রানীই নন, এমন বহু নারীকে দেখা যায়, যাঁরা নদীর কোমরপানিতে বা চরে কাদা মেখে রেণু পোনা তুলছেন।
সরেজমিনে সবখানে ঘুরে একই চিত্র দেখা যায়। পোনা ধরা শেষ হলে চরের কাদায় বসে চলে পোনা গোনা আর বাছাই, তারপর আবার জাল টানা। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই পোনাগুলো চলে যায় ফড়িয়ার হাতে। জেলেরা হাজারখানেক রেণু বিক্রি করেন গড়ে এক হাজার টাকায়। তাতেই দিনের খাওয়া-পরার জোগাড়। কেউ আয় করেন ২০০, কেউ ৩০০। সেটুকু দিয়েই চলে দিন, কাটে রাত। জীবিকার লোনাপানি নারীর জীবনে ডেকে আনছে নতুন বিপদ। দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা সুদীপ বালা বলেন, ‘বছরজুড়ে চিকিৎসা নিতে আসা উপকূলের নারীদের রোগের বড় অংশই প্রজনন অঙ্গের। মাটি আর পানিতে সহনশীল মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ। অপুষ্টি আর সচেতনতার অভাব মিলিয়ে এই রোগগুলো বাসা বাঁধছে।’সুন্দরবন ও উপকূল সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব বলেন, সুন্দরবনসংলগ্ন নদী–তীরবর্তী ৩০টির মতো গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ জাল টেনে পোনা ধরেই বাঁচেন। নদীর লোনাপানি কেবল পোনা দেয় না, দিয়ে যায় দুঃখও। তবু জাল ছাড়েন না তাঁরা। কারণ, নদীর একমুঠো পোনা মানেই একমুঠো ভাত। আর সেই ভাতের জন্যই রোজ নতুন করে নদীতে নামেন খুকু দাশের মতো হাজারো নারী।
সংবাদটি শেয়ার করুন
আরো সংবাদ পড়ুন