কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:মাহিদুল ইসলাম।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে কুড়িগ্রাম জেলার ইটভাটা খাতে অব্যাহত দুর্নীতি, অনিয়ম ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার একটি করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের একাধিক অভিযান, মোটা অংকের জরিমানা এবং বন্ধের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও জেলার অধিকাংশ অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম থেমে নেই। বরং গোপন সমঝোতা, আর্থিক লেনদেন এবং প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দিন দিন বেড়েই চলেছে এ সকল পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড।সংবাদের ভিত্তিতে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য— পরিবেশ অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু ব্যক্তি নানা অজুহাতে অনুমোদনহীন ইটভাটাগুলোকে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে। অভিযানের আগেই এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের পথ সুগম করা হয়।জেলা পরিসংখ্যান অফিস সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় ১০৮টি ইটভাটার মধ্যে ৭৬টিই অনুমোদনহীন ও অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। উলিপুর উপজেলায় ১৭টি, নাগেশ্বরীতে ১৫টি, সদর উপজেলায় ১৩টি, রৌমারীতে ৮টি, রাজিবপুর ও ফুলবাড়ীতে ৬টি করে, ভুরুঙ্গামারী ও চিলমারীতে ৫টি করে এবং রাজারহাটে ১টি অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে।ফুলবাড়ী উপজেলার অবৈধ ইটভাটার তালিকায় রয়েছে: মের্সাস ডব্লিউ এ এইচ ব্রিকস, মের্সাস এ বি ব্রিকস, মের্সাস এম এস এইচ ব্রিকস, মের্সাস কে এম ব্রিকস, মের্সাস আলতাফ ব্রিকস (MAB)। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর, কুড়িগ্রামের মোবাইল কোর্ট/অভিযান পরিচালনার তালিকায় নেই ‘মেসার্স জেএমএস (JMS) ব্রিকস’-এর নাম। অথচ এই ভাটাটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফকিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাত্র ১৪৫ মিটার দূরত্বে অবস্থিত, যেখানে আইনানুযায়ী ন্যূনতম ১ কিলোমিটার দূরত্ব বজায় রাখা আবশ্যক। এ ছাড়াও ফুলবাড়ীর প্রতিটি ইটভাটার ৪০০ থেকে ৪৫০ মিটারের মধ্যেই রয়েছে নামধারী সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ-মন্দিরসহ জনবসতি। এই চিত্র শুধু ফুলবাড়ীর নয়, জেলার প্রতিটি উপজেলার বাস্তবতাই একই রকম।এ যেন দুর্নীতির এক নগ্ন চিত্র— "যার টাকা, তার আইন; যার সাধ্য, তার স্বার্থরক্ষা।" আইনের চোখও যেখানে টাকার ওজন দেখে, সেখানে ন্যায়বিচারের কী মূল্য?
ফুলবাড়ী উপজেলায় মের্সাস আলতাফ ব্রিকস (MAB) এর নিকটবর্তী ২৪০ মিটার দূরত্বে ছাইফুল রহমান মহাবিদ্যালয় অবস্থিত, অথচ অন্যান্য ভাটাগুলো আরও কম দূরত্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার পরও অক্ষত রয়েছে। গোপন সূত্র মতে, ভাটার মালিকদের সাথে আর্থিক বা অবৈতনিক সুবিধা আদান-প্রদান বা সমঝোতা যেসব ক্ষেত্রে ভেঙে পড়েছে, সেসব ভাটায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে। আর যেসব ক্ষেত্রে সুবিধার সমন্বয় ঘটেছে, সেখানে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে নির্বিঘ্নে।বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী: ১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, জনবসতি ও বনাঞ্চল থেকে ন্যূনতম ১ কিলোমিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ২. পরিবেশগত ছাড়পত্র ব্যতীত ইটভাটা পরিচালনা করা সম্পূর্ণ অবৈধ। ৩. কৃষিজমি, বনজমি, জলাশয়ের মাটি ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ৪. আইন লঙ্ঘনে জরিমানা, উচ্ছেদ, ভাটা বন্ধসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।তবে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোথাও ৫০ হাজার, কোথাও ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা আরোপ করা হলেও কোথাও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণই করা হয়নি। "আইন সবার জন্য সমান"— এই চিরন্তন প্রবাদ যেন এখানে অর্থহীন। কোনো কোনো ভাটায় আগুন নিভিয়ে দেয়ার নাটক করে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে, আবার কোথাও আংশিক অবকাঠামো ভেঙে অভিযান সমাপ্ত দেখানো হয়েছে। অবৈধতার বিষয়ে প্রশ্ন উঠলেও কিছু ভাটা থেকে রাজস্ব (ভ্যাট) বাবদ ২ লক্ষ টাকা এবং ইনকাম ট্যাক্স বাবদ ৮০ হাজার টাকা ব্যাংকের চালান মূলে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে—যা এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। আইন অনুযায়ী অবৈধ ইটভাটা পরিচালনা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও, তাদের কাছ থেকে রাজস্ব গ্রহণ যেন “অবৈধকে বৈধতার ছাপ দেয়া”র এক নজির। একদিকে অবৈধ ঘোষণা, অন্যদিকে অর্থ সংগ্রহ—এ যেন "মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে মধু খাওয়ার স্বপ্ন।" অন্যদিকে, জেলার ৯টি উপজেলার ১০৮টি ইটভাটার মধ্যে ৭৬টিই অবৈধ—অর্থাৎ ৭০ শতাংশের বেশি ইটভাটা নিয়ম বহির্ভূতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে— "জল যেই পাত্রেই পড়ুক, চোরাবালি তলানিতে থেকেই যায়।" এই বিপুল সংখ্যক অবৈধ ভাটার আয় কোথায় যাচ্ছে? কার পকেটে ঢুকছে এই রাজস্বের সিংহভাগ? সরকারি কোষাগারে যাওয়া নামমাত্র অংকের বাইরে কত কোটি টাকার হিসেব ভিন্ন খাতে চলে যাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা জরুরি।গোপন সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু ব্যক্তি একটি সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে অবৈধ ইটভাটাগুলোর সাথে অস্বচ্ছ সমঝোতা করে, যা থেকে প্রতিনিয়ত মোটা অংকের সুবিধা আদায় করা হয়। এমনকি সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একাধিক কল রেকর্ডেও এর সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, "জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক ও জেলা প্রশাসনের সহায়তায় অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আমাদের মোবাইল কোর্ট অভিযান চলমান আছে। গত মৌসুমে আমরা সকল উপজেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার চেষ্টা করেছি এবং কিছু ভাটা বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছি, যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রশংসিত হয়েছে। ম্যানেজ সংক্রান্ত এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। পরবর্তী মৌসুমেও জেলা প্রশাসনের সাথে যৌথভাবে অভিযান অব্যাহত থাকবে।"উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় দেশের সকল অবৈধ ইটভাটা বন্ধের আদেশ থাকলেও কুড়িগ্রামে সেই আদেশ কার্যকর হওয়ার পরিবর্তে চলছে এক ধরনের বিচিত্র নাটক। কোথাও শুধু অর্থদণ্ড আরোপ, কোথাও আংশিক অবকাঠামো ভেঙে কার্যক্রম চালু, কোথাও আগুন নিভিয়ে সাময়িক বন্ধ দেখানো আবার কোথাও কোনো ধরনের অভিযানই চালানো হচ্ছে না। এটি যেন আইনের দৃষ্টিতে এক অপরাধের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা, এক পক্ষের জন্য কঠোরতা, অন্য পক্ষের জন্য নমনীয়তা। এই বৈষম্যের মূলে রয়েছে আর্থিক লেনদেন, প্রভ